কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে সোনার চাহিদা বাড়ছে। ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস বিক্রির টাকা ব্যাংক কিংবা লকারে রাখার সুযোগ না থাকায় রোহিঙ্গারা সোনা কিনে রাখাকেই নিরাপদ মনে করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের চেয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সোনার দাম ভরিতে পাঁচ-সাত হাজার টাকা কম। সে কারণে লাভের আশায় মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে সোনা আনছেন রোহিঙ্গারা। এসব সোনা ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে।
সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের কাস্টমস মোড় এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ৩ কেজি ৩২২ গ্রাম ওজনের ২০টি সোনার বারসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। কবির আহমদ (৩০) নামের ওই ব্যক্তির বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকায়।
৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মেহেদী হোসাইন কবির বলেন, মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আনা সোনার চালানটি উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে নেওয়া হচ্ছিল। উদ্ধার করা সোনার বারগুলো কবির আহমদের কোমরে লুঙ্গির ভাঁজে লুকানো ছিল। উদ্ধার করা সোনার বাজারমূল্য ২ কোটি ২৭ লাখ টাকার বেশি।
৩৪ বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ সোনা উদ্ধারের ঘটনার আগে গত ৮ মাসে কেবলমাত্র নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, উখিয়ার রহমতের বিল, পালংখালী সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ১৭১ কোটি টাকা মূল্যের ৫৬ লাখ ৮১ হাজার ইয়াবা, ৭০ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের ১৪ কেজি ২০ গ্রাম আইস এবং ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা মূল্যের ৩ কেজি ৩২৩ গ্রাম ওজনের ২৪টি সোনার বার উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৭৫ জন চোরাকারবারিকে।
টেকনাফ ২ বিজিবি গত এক বছরে উদ্ধার করেছে ৪৬৩ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৩৩৩ জন মাদক কারবারিকে। উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে ইয়াবা ৪০ লাখ ৩২ হাজার পিস ও আইস ৫৪ কেজি ৫৭০ গ্রাম। এ ছাড়াও এ সময়ে সোনা উদ্ধার করা হয়েছে ২১ কেজি ৮০৭ গ্রাম।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমারের সোনার দাম কিছুটা কম। এ কারণে এখানে চাহিদা বেশি।
মিয়ানমারের সোনার কদর বেশি কেন
উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। এর মধ্যে ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা সোনা ও মাদক চোরাচালানে জড়িত দাবি করেন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা জাফর আলম (৫৫)। তিনি বলেন, পাঁচ বছর ধরে রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবিরে পড়ে আছেন। ছয় লাখ তরুণ-যুবক বেকার। প্রত্যাবাসনও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ কারণে হতাশ তরুণ-যুবকেরা মাদক ও সোনা চোরাচালানে জড়াচ্ছে।
মাদক বিক্রির লাখ লাখ টাকা ব্যাংক কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানে জমা রাখার সুযোগ রোহিঙ্গাদের নেই। নগদ টাকা আশ্রয়শিবিরের ঝুপড়িঘরে রাখাও বিপদ। তাই রোহিঙ্গারা নগদ টাকায় কিনে রাখে সোনা। পরিমাণে অল্প হওয়ায় সোনার বার মাটির নিচে কিংবা ঘরের কোথাও লুকিয়ে রাখা যায়।
কামাল আহমদ, রোহিঙ্গা নেতা, বালুখালী আশ্রয়শিবির
বালুখালী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা কামাল আহমদ (৫২) বলেন, মাদক বিক্রির লাখ লাখ টাকা ব্যাংক কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানে জমা রাখার সুযোগ রোহিঙ্গাদের নেই। নগদ টাকা আশ্রয়শিবিরের ঝুপড়িঘরে রাখাও বিপদ। তাই রোহিঙ্গারা নগদ টাকায় কিনে রাখে সোনা। পরিমাণে অল্প হওয়ায় সোনার বার মাটির নিচে কিংবা ঘরের কোথাও লুকিয়ে রাখা যায়। অধিকাংশ রোহিঙ্গা পরিবারেই কমবেশি সোনার মজুত আছে বলে জানান তিনি।
গত ১৪ জুন উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ ইস্ট) বি-ব্লকের সিদ্দিক আহমদের বসতঘরে তল্লাশি চালায় ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এ সময় ঘরের মেঝেতে লুকিয়ে রাখা ৩ লাখ ২৩ হাজার পিস ইয়াবা এবং ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার, ২ লাখ ৫৮ হাজার ৫২০ টাকা ও ১ হাজার ২৩৫ মিয়ানমারের মুদ্রা (কিয়াট) উদ্ধার করে বিজিবি। অভিযানে সিদ্দিক আহমেদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমসহ (২৯) তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে ১৯ জুন ১৪ এপিবিএন কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের এ–ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ আইয়ুব আলীর ঝুপড়িঘরে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করে ৩টি সোনার বারসহ ৭০ ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার, ২৬ লাখ ৩ হাজার টাকা ও ৩১ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ কিয়াট। এ সময় আইয়ুব আলী (৩৮) ও তাঁর স্ত্রী নুরুনেসাকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়।
১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (সদ্য খাগড়াছড়িতে বদলি) ও পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক বলেন, মাদক বিক্রির টাকায় রোহিঙ্গারা সোনার বার কিংবা স্বর্ণালংকার কিনে রাখছে। শুরুর দিকে আশ্রয়শিবিরে স্বর্ণালংকার বেচাবিক্রির বেশ কিছু দোকান ছিল। এপিবিএন আশ্রয়শিবিরের দায়িত্ব নেওয়ার পর (২০২০ সালের ১ জুন) দোকানগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এখন আশ্রয়শিবিরের বাইরে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের কাছে বেশ কিছু জুয়েলারি দোকান রয়েছে। বাংলাদেশিরা এসব পরিচালনা করে।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মাদকের টাকা ছাড়াও বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছে বিপুল টাকা আসে। আশ্রয়শিবিরগুলোর ভেতরে গড়ে ওঠা ৩৭ হাজারের বেশি দোকানপাটে দৈনিক ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এই টাকা ও স্থানীয় শ্রমবাজার থেকে আয়ের টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা নেই। তাই রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমারের সোনার কদর বেশি। রাখাইন রাজ্যে থাকতেও রোহিঙ্গারা টাকার পরিবর্তে সোনার মজুত গড়তেন।
মাদক, আইস, সোনাসহ মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে যা আসে, সবকিছুর টাকা লেনদেন হচ্ছে হুন্ডিতে
শেখ মোহাম্মদ আলী, ওসি, উখিয়া থানা
কক্সবাজারে এ পর্যন্ত সোনার সবচেয়ে বড় চালানটি ধরা পড়েছে গত বছরের ৯ আগস্ট। ওই দিন উখিয়ার টিভি টাওয়ারের সামনে থেকে ২ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ৪৭০ ভরি ওজনের ৩৩টি সোনার বারসহ মো. জয়নুল আবেদিন (৬৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি শূন্যরেখায় গড়ে ওঠা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। বিজিবি জানায়, মিয়ানমার থেকে সোনার চালান নিয়ে জয়নুল উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে যাচ্ছিলেন। জয়নুল আবেদিন তখন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন, সোনা ও মাদক বিক্রির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে পৌঁছানো হয়।
গত বছরের ১ নভেম্বর উখিয়ার পালংখালী কুড়ারপাড়া এলাকায় থেকে ৩২টি সোনার বারসহ বিজিবি গ্রেপ্তার করেছিল রোহিঙ্গা তরুণ মো. কলিমকে (২১)। তিনি উখিয়া কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা। কলিমও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেনের কথা তুলে ধরেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
উখিয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, মাদক, আইস, সোনাসহ মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে যা আসে, সবকিছুর টাকা লেনদেন হচ্ছে হুন্ডিতে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, দেশে ভালো মানের প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে ৮৪ হাজার টাকার বেশি দামে। কিন্তু মিয়ানমারের সোনা পাঁচ-সাত হাজার টাকা কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে অনেকে মিয়ানমারের সোনার দিকে ঝুঁকছেন। উখিয়া-টেকনাফের মানুষও মিয়ানমার থেকে আসা সোনা ব্যবহার করেন। এসব কারণে আশ্রয়শিবিরগুলোতে নতুন নতুন কারবারি তৈরি হচ্ছে। সুত্র : প্রথম আলো
পাঠকের মতামত